কম্পিউটার এর ইতিহাস (Evolution of Computer)

    কম্পিউটার আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে আধুনিক কম্পিউটার এখন দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সহ সমস্ত কিছুতে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে গেছে। তবে বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় আবিষ্কার কম্পিউটার হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। অনেক সময় ধরে অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের আধুনিক কম্পিউটার এর রূপ পেয়েছে। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে আবিষ্কারের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে যন্ত্র গুলির মধ্য দিয়ে কম্পিউটার এর যে বিবর্তন (কম্পিউটার এর ইতিহাস)  ঘটেছে, তার বিস্তারিত আলোচনা করা হল –

কম্পিউটার এর ইতিহাস (Evolution of Computer)

অ্যাবাকাস (Abacus) : আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চীন দেশে অ্যাবাকাস (Abacus) নামক যন্ত্র তৈরির মধ্য দিয়ে প্রথম গণনাকারী যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। এই যন্ত্রটির সাহায্যে শুধুমাত্র যোগ, বিয়োগ করা যেত। সরাসরি এই যন্ত্রের সাহায্যে গুন, ভাগ করা সম্ভব ছিল না। কাঠ বা ধাতুর ফ্রেমে কিছু তার এবং সেই তারে পুঁতি লাগানো থাকতো, সেই তারে লাগানো পুঁতি গুলি তারের মধ্যে চলাচল করতে পারতো। পুঁতি গুলির অবস্থান পরিবর্তন করে যোগ, বিয়োগ করা সম্ভব ছিল। প্রথমে অ্যাবাকাস এর ব্যবহার চীন দেশে শুরু হলেও পরে রাশিয়া, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জাপানে এই অ্যাবাকাস (Abacus) যন্ত্রকে বলা হত সোরাব্যান (Soraban) তবে অ্যাবাকাস যন্ত্রের আবিষ্কারকের নাম আজও অজানা।

নেপিয়ারস বোন (Nepier’s Bone) : ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ বিজ্ঞানী জন নেপিয়ার (John Napier) একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার নাম নেপিয়ারস বোন (Napier’s Bone) বা নেপিয়ারের হাড়। অ্যাবাকাস যন্ত্রে শুধুমাত্র যোগ ও বিয়োগ করা সম্ভব ছিল কিন্তু এই যন্ত্রের সাহায্যে যোগ, বিয়োগ ছাড়াও গুন করাও সম্ভব ছিল। তবে বড়ো বড়ো যোগ, বিয়োগ, গুন করা সম্ভব হত না। এই যন্ত্রটিতে দশটি রেখাঙ্কিত লম্বা দন্ড থাকত, যার সাহায্যে যোগ, বিয়োগ, গুন করা যেত। পড়ে জন নেপিয়ার “নেপিয়ার লগারিদম্” নামে একটি গানিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে গুন, ভাগ, বর্গমূল নির্ণয় করা যেত।

স্লাইড রুল (Slide Rule) : ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ গণিতজ্ঞ উইলিয়াম অগট্রেড (William Oughtred), জন নেপিরার এর তৈরি ‘নেপিয়ারস বোন’ যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেন স্লাইডিং স্কেল, যাকে “স্লাইড রুল” বলা হয়। স্লাইডিং স্কেলটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটি মোটা অংশের মধ্যে দ্বিতীয় সরু অংশটি লাগানো থাকত। স্কেলের মোটা অংশের খাঁজে সরু অংশটি লাগানো থাকতো ফলে সরু অংশটি খাঁজের এপাশ-ওপাশ সরানো যেত। দুটি স্কেলের গায়ে সংখ্যা লেখা ছিল ফলে স্কেল এপাশ-ওপাশ করার মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ ইত্যাদি নির্ণয় করা যেত। তবে খুব বড়ো অঙ্ক করা অসম্ভব ছিল।

পাস্কালিন (Pascaline) : ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ফরাসী গণিতবিদ ব্লেস পাসকাল (Blaise Pascal) একটি উন্নত মানের যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে বড়ো বড়ো যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ ইত্যাদি সমাধান করা সম্ভব হত। এটিকে প্রথমে ক্যালকুলেটর বলে আখ্যা দেওয়া হয়। পরে পাসকালের নাম অনুসারে এই যন্ত্রটির নাম হয় পাস্কালিন (Pascaline) যন্ত্র।

স্টেপড রেকনার (Stepped Reckoner) : ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী উইলহিয়াম লেবনিজ (Gottfried Wilhelm Leibniz) পাস্কালিন যন্ত্রের উন্নতি ঘটিয়ে ডিজিটাল মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটর (Digital Mechanical Calculator) আবিষ্কার করেন যা “স্টেপড রেকনার” (Stepped Reckoner) বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সর্বপ্রথম যে যন্ত্রটির দ্বারা কোনো যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ এই চারটি গাণিতিক কাজই করা যেত, তা হল এই লেবনিজের “স্টেপড রেকনার”।

ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine) : ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage) ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine) নামে একটি গণকযন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রটিতে একটি মেমোরি (Memory) বা স্মৃতিভাণ্ডার ছিল ফলে তথ্য ধরে রাখতে পারতো এবং অনেকগুলি কাজ একসঙ্গে করতে সক্ষম ছিল।

অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন (Analitical Engine) : ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage) “অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন” (Analitical Engine) নামে একটি নতুন স্বয়ংক্রিয় গণকযন্ত্রের পরিকল্পনা করেন যা ডিফারেন্স ইঞ্জিন থেকে অনেক উন্নত প্রযুক্তির। চার্লস ব্যবেজের এই অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনে পাঁচটি অংশ ছিল –

1.     স্টোর (Store)

2.     অ্যারিথমেটিক ইউনিট (Arithmetic Unit)

3.     কন্ট্রোল ইউনিট (Control Unit)

4.     ইনপুট ইউনিট (Input Unit)

5.     আউটপুট ইউনিট (Output Unit)

সেই সময় বিজ্ঞান প্রযুক্তি উন্নত না থাকার কারনে বিজ্ঞানী ব্যাবেজের এই চিন্তা-ভাবনা বা পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ব্যাবেজের পরিকল্পনাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীকালে অন্যান্য বিজ্ঞানীগণ ব্যাবেজের প্রচেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। চার্লস ব্যাবেজের এই প্রচেষ্টাকেই কাজে লাগিয়ে আধুনিক কম্পিউটার এর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই কারনেই বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজকে আধুনিক কম্পিউটার এর জনক বলা হয়।

পাঞ্চকার্ড (Punch Card) : একাধিক ছিদ্রযুক্ত একধরনের যন্ত্র হল পাঞ্চকার্ড যা ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ব্যবহার হয়েছিল।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী হারমান হলেরিথ (Herman Hollerith) আমেরিকার জনগণনার কাজ সম্পাদনের জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। বিজ্ঞানী হারমান হলেরিথ এর কোম্পানি এবং আরও কয়েকটি কোম্পানি মিলিত হয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন (International Business Machine) কোম্পানির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাঞ্চকার্ডের উন্নতির জন্য ট্যাবুলেটর (Tabulator) এবং সর্টার (Sorter) নামক দুটি যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়।

মার্ক-I (Mark-I) : ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড আইকেন (Haward Aiken) IBM কোম্পানির সহায়তায় ইলেক্ট্রনিক মেকানিক্যাল (Electronic Mechanical) কম্পিউটার তৈরি করেন। এর নামকরন করা হয় Mark-I নামে। এই যন্ত্রটি পাঞ্চকার্ডের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং আকারে অনেক বড়ো ছিল (দৈর্ঘ্য ছিল ১৫ মিটার, উচ্চতা ছিল ২.৪ মিটার)। পাঞ্চকার্ডের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে ৩০০০ টি স্যুইচ ছিল এবং গাণিতিক কাজগুলি দ্রুত করতে পারতো (যোগের জন্য ০.৩ সেকেন্ড সময় লাগত)। এই যন্ত্রটিকে আধুনিক যুগের প্রথম গনকযন্ত্র বলা হয়।

এনিয়াক (ENIAC) : মার্ক-I আবিষ্কারের প্রায় ৪(চার) বছর পর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত হয় “এনিয়াক” (ENIAC), যার সম্পূর্ণ নাম হল ইলেকট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্ট্রিগ্রেটর অ্যান্ড কম্পিউটার (Electronic Numerical Integrator and Computer)পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মুর স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (Moore School of Engineering) এর দুইজন অধ্যাপক জে. পি. একার্ট (J. P. Eckart) ও জন মাউচলি (Jhon Mouchly) “এনিয়াক” আবিষ্কার করেন।

এডস্যাক (EDSAC) : ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক মরিস উইলকিস (Mourice Wilkes) যে কম্পিউটার তৈরি করেন সেটি হল “এডস্যাক” (EDSAC), যার সম্পূর্ণ নাম ইলেকট্রনিক ডিলে স্টোরেজ অটোম্যাটিক ক্যালকুলেটর (Electronic Delay Storage Automatic Calculator)

ইউনিভ্যাক-১ (UNIVAC-1) : ১৯৫১ সালে জে. পি. একার্ট (J. P. Eckart) ও জন মাউচলি (Jhon Mouchly) আবিষ্কার করেন “ইউনিভ্যাক-১” (UNIVAC-1 এর সম্পূর্ণ নাম Universal Automatic Computer-1)এই কম্পিউটার বানিজ্যিক ও প্রশাসনিক কাজকর্মে ব্যবহার করা হয়েছিল।

একভ্যাক (EDVAC) : ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে জে. পি. একার্ট (J. P. Eckart) ও জন মাউচলি (Jhon Mouchly) জন ভন নিউম্যানের ধারনা অনুসারে “এডভ্যাক” (EDVAC) কম্পিউটার আবিষ্কার করেন। যার সম্পূর্ণ নাম ইলেকট্রনিক ডেসক্রিট ভেরিয়েবল অটোমেটিক কম্পিউটার (Electronic Discrete Variable Automatic Computer)এই কম্পিউটারটি ENIAC কম্পিউটার এর ভুলগুলি সংশোধন করে তৈরি করা হয়েছিল।

 

এই হল কম্পিউটার এর ইতিহাসের বিস্তারিত আলোচনা। ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং নিচে কমেন্ট করে আমাদের উৎসাহিত করুন যাতে আমরা আরও অনেক কিছু তথ্য এখানে আপডেট করতে পারি। 

 

Post a Comment

0 Comments