তপোভঙ্গ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যৌবনবেদনারসে
উচ্ছল আমার দিনগুলি,
হে কালের অধীশ্বর, অন্যমনে গিয়েছ কি ভুলি,
হে ভোলা সন্ন্যাসী।
চঞ্চল চৈত্রের
রাতে কিংশুকমঞ্জরী
সাথে
শূন্যের অকূলে
তারা অযত্নে গেল কি সব ভাসি?
আশ্বিনের
বৃষ্টিহারা শীর্ণশুভ্র মেঘের ভেলায়
গেল বিস্মৃতির ঘাটে স্বেচ্ছাচারী হাওয়ার খেলায়
নির্মম হেলায়?
একদা সে দিনগুলি
তোমার পিঙ্গল জটাজালে
শ্বেত রক্ত নীল পীত নানা পুষ্পে বিচিত্র সাজালে,
গেছ কি পাশরি?
দস্যু তারা হেসে
হেসে হে
ভিক্ষুক,
নিল শেষে
তোমার ডম্বরু
শিঙা,
হাতে দিল মঞ্জিরা বাঁশরি।
গন্ধভারে আমন্থর
বসন্তের উন্মাদন-রসে
ভরি তব কমণ্ডলু নিমজ্জিল নিবিড় আলসে
মাধুর্যরভসে।।
সেদিন তপস্যা তব
অকস্মাৎ শূন্যে গেল ভেসে
শুষ্কপত্রে ঘূর্ণবেগে গীতরিক্ত হিমমরুদেশে
উত্তরের মুখে।
তব
ধ্যানমন্ত্রটিরে আনিল বাহির তীরে
পুষ্পগন্ধে
লক্ষ্যহারা দক্ষিণের বায়ুর কৌতুকে।
সে মন্ত্রে উঠিল
মাতি সেঁউতি কাঞ্চন করবিকা
সে মন্ত্রে নবীনপত্রে জ্বালি দিল অরণ্যবীথিকা
শ্যামবহ্নিশিখা।।
বসন্তের
বন্যাস্রোতে সন্ন্যাসের হল অবসান;
জটিল জটার বন্ধে জাহ্নবীর অশ্রুকলতান
শুনিলে তন্ময়।
সেদিন ঐশ্বর্য
তব উন্মেষিল
নব নব
অন্তরে উদ্বেল
হল আপনাতে আপন বিস্ময়।
আপনি সন্ধান
পেলে আপনার সৌন্দর্য উদার,
আনন্দে ধরিলে হাতে জ্যোতির্ময় পাত্রটি সুধার
বিশ্বের ক্ষুধার।।
সেদিন, উন্মত্ত তুমি, যে নৃত্যে ফিরিলে বনে বনে
সে-নৃত্যের ছন্দে-লয়ে সংগীত রচিনু ক্ষণে ক্ষণে
তব সঙ্গ ধরে।
ললাটের
চন্দ্রালোকে নন্দনের
স্বপ্ন-চোখে
নিত্য-নূতনের
লীলা দেখেছিনু চিত্ত মোর ভরে।
দেখেছিনু
সুন্দরের অন্তর্লীন হাসির রঙ্গিমা,
দেখেছিনু লজ্জিতের পুলকের কুণ্ঠিত ভঙ্গিমা,
রূপ-তরঙ্গিমা।।
সেদিনের
পানপাত্র,
আজ তার ঘুচালে পূর্ণতা?
মুছিলে চুম্বনরাগে-চিহ্নিত বঙ্কিম রেখা-লতা
রক্তিম অঙ্কনে?
অগীত সংগীতধার, অশ্রুর
সঞ্চয়ভার
অযত্নে লুণ্ঠিত
সে কি ভগ্নভাণ্ডে তোমার অঙ্গনে?
তোমার তাণ্ডব
নৃত্যে চূর্ণ চূর্ণ হয়েছে সে ধূলি?
নিঃস্ব কালবৈশাখীর নিশ্বাসে কি উঠিছে আকুলি
লুপ্ত দিনগুলি?
নহে নহে, আছে তারা; নিয়েছ তাদের সংহরিয়া
নিগূঢ় ধ্যানের রাত্রে, নিঃশব্দের মাঝে সম্বরিয়া
রাখ সংগোপনে।
তোমার জটায় হারা গঙ্গা
আজ শান্তধারা,
তোমার ললাটে
চন্দ্র গুপ্ত আজি সুপ্তির বন্ধনে।
আবার কী
লীলাচ্ছলে অকিঞ্চন সেজেছ বাহিরে।
অন্ধকারে নিঃস্বনিছে যত দূরে দিগন্তে চাহি রে---
‘নাহি রে, নাহি রে’।।
কালের রাখাল
তুমি,
সন্ধ্যায় তোমার শিঙা বাজে,
দিনধেনু ফিরে আসে স্তব্ধ তব গোষ্ঠগৃহমাঝে,
উৎকণ্ঠিত বেগে।
নির্জন
প্রান্তরতলে আলেয়ার
আলো জ্বলে,
বিদ্যুৎ-বহ্নির
সর্প হানে ফণা যুগান্তের মেঘে।
চঞ্চল মুহূর্ত
যত অন্ধকারে দুঃসহ নৈরাশে
নিবিড় নিবদ্ধ হয়ে তপস্যার নিরুদ্ধ নিশ্বাসে
শান্ত হয়ে আসে।।
জানি জানি, এ তপস্যা দীর্ঘরাত্রি করিছে সন্ধান
চঞ্চলের নৃত্যস্রোতে আপন উন্মত্ত অবসান
দুরন্ত উল্লাসে।
বন্দী যৌবনের
দিন আবার
শৃঙ্খলহীন
বারে বারে
বাহিরিবে ব্যগ্র বেগে উচ্চ কলোচ্ছ্বাসে।
বিদ্রোহী নবীন
বীর,
স্থবিরের শাসন নাশন,
বারে বারে দেখা দিবে; আমি রচি তারি সিংহাসন,
তারি সম্ভাষণ।।
তপোভঙ্গ-দূত আমি
মহেন্দ্রের, হে রুদ্র সন্ন্যাসী,
স্বর্গের চক্রান্ত আমি। আমি কবি যুগে যুগে আসি
তব তপোবনে।
দুর্জয়ের জয়মালা পূর্ণ
করে মোর ডালা,
উদ্দামের উতরোল
বাজে মোর ছন্দের ক্রন্দনে।
ব্যথার প্রলাপে
মোর গোলাপে গোলাপে জাগে বাণী,
কিশলয়ে কিশলয়ে কৌতূহল-কোলাহল আনি
মোর গান হানি।।
হে শুষ্ক
বল্কলধারী বৈরাগী, ছলনা জানি সব---
সুন্দরের হাতে চাও আনন্দে একান্ত পরাভব
ছদ্মরণবেশে।
বারে বারে
পঞ্চশরে অগ্নিতেজে
দগ্ধ করে
দ্বিগুণ উজ্জ্বল
করি বারে বারে বাঁচাইবে শেষে।
বারে বারে তারি
তূণ সম্মোহনে ভরি দিব বলে
আমি কবি সংগীতের ইন্দ্রজাল নিয়ে আসি চলে
মৃত্তিকার কোলে।।
জানি জানি, বারম্বার প্রেয়সীর পীড়িত প্রার্থনা
শুনিয়া জাগিতে চাও আচম্বিতে, ওগো অন্যমনা,
নূতন উৎসাহে।
তাই তুমি
ধ্যানচ্ছলে বিলীন
বিরহতলে,
উমাকে কাঁদাতে
চাও বিচ্ছেদের দীপ্তদুঃখদাহে।
ভগ্ন তপস্যার
পরে মিলনের বিচিত্র সে ছবি
দেখি আমি যুগে যুগে, বীণাতন্ত্রে বাজাই ভৈরবী,
আমি সেই কবি।।
আমারে চেনে না
তব শ্মশানের বৈরাগ্যবিলাসী,
দারিদ্রের উগ্র দর্পে খলখল ওঠে অট্টহাসি
দেখে মোর সাজ।
হেনকালে মধুমাসে মিলনের
লগ্ন আসে,
উমার কপোলে লাগে
স্মিতহাস্য-বিকশিত লাজ।
সেদিন কবিরে
ডাকো বিবাহের যাত্রাপথতলে,
পুষ্পমাল্যমাঙ্গল্যের সাজি লয়ে, সপ্তর্ষির দলে
কবি সঙ্গে চলে।।
ভৈরব, সেদিন তব প্রেতসঙ্গিদল রক্ত-আঁখি
দেখে তব শুভ্রতনু রক্তাংশুকে রহিয়াছে ঢাকি,
প্রাতঃসূর্যরুচি।
অস্থিমালা গেছে
খুলে মাধবীবল্লরীমূলে,
ভালে মাখা
পুষ্পরেণু, চিতাভস্ম কোথা গেছে মুছি।
কৌতুকে হাসেন
উমা কটাক্ষে লক্ষিয়া কবি-পানে;
সে হাস্যে মন্দ্রিল বাঁশি সুন্দরের জয়ধ্বনিগানে
কবির পরানে।
0 Comments