তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ - বিষ্ণু দে
তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ, কবি?
হরেক
উৎসবে হই হই
মঞ্চে
মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?
তুমি
শুধু পঁচিশে বৈশাখ
আর বাইশে
শ্রাবণ?
কালবৈশাখীর
তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা,
বাদলের
প্রবল প্লাবন,
সবই শুধু
বৎসরান্তে একদিনেই নির্গত নিঃশেষ?
অপঠিত, নির্মনন, নেই আর কোনো আবেদন?
সাবিত্রীর
ক্ষিপ্রকর বিভা
আমাদের
দুঃস্থ চির গোধুলিতে ম্রিয়মাণ?
তোমারই
কি ছিল এই নিরানন্দ ভঙ্গুর স্বদেশ
আলোহীন
অন্ধকারহীন আপন সত্তার থেকে পলাতক
নিস্তব্ধ
থাকার ভয়ে একার সংশয়ে জনতার অপমানে
নিত্য
রুচি ক্ষয়ে ক্ষয়ে অসুন্দর?
কোথায় সে
প্রতিদিন রুপের রচনা,
সেই
নিরন্তর সুন্দরের ধ্যানের উন্মেষ,
অনাত্মীকরনে
সদা নিজেকে সে উত্তরণ,
নিরলস
জ্ঞানের নিয়ম
কঠিন
শিক্ষার শ্রম,
বুদ্ধির
নির্ভয় শুভ্র আলোকে আলোকে,
আত্মস্থের
স্তব্ধতার স্তব্ধ অন্ধকারে
শূন্যে
শূন্যে ব্যথাময় অগ্নিবাষ্পে দীপ্ত গীতে
চৈতন্যের
জ্যোতিষ্কে জ্যোৎস্নায়
উদ্ ভাসিত সুদীর্ঘ জীবন,
যেখানে
পর্বত ওড়ে আশ্বিনের নিরুদ্দেশ মেঘ,
সন্ধ্যারাগে
ঝিলিমিলি ঝিলমের বাঁকা তলোয়ার,
নদীর
নূপুরে বাজে নদীর জোয়ার,
শিহরায়
দেওদার বন।
তোমার
আকাশ দাও, কবি, দাও
দীর্ঘ
আশি বছরের
আমাদের
ক্ষীয়মাণ মানসে ছড়াও
সূর্যোদয়
সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো,
বহুধা
কীর্তিতে শত শিল্পকর্মে উন্মুক্ত উধাও
তোমার
কীর্তিতে আর তোমাতে যা দিকে দিকে
একাগ্র
মহৎ,
সে কঠিন
ব্রতের গৌরবে,
আমাদের
বিকারের গড্ডল ধুলার দিনরাত অন্যায়ে কুৎসিতে
শুনি যেন
সুন্দরের গান
দেখি যেন
একনিষ্ঠ দীর্ঘায়ুর প্রগতির এক ছবি,
সুন্দরের
গান যেন শুনি, গাই,
দ্ শটার পাঁচটার উদভ্রান্ত ট্রাফিকে,
বস্তিতে
বাসায় আর বাংলার নয়া কলোনিতে,
জীবিকার
জীবনের ভাঙা ধসা ভিতে,
বোম্বাই
সিনেমা আর মার্কিনী মাইকে অসুস্থ বৈভবে,
মরা খেতে
কারখানায় পড়ি যেন জীবনের
সংগ্রামশান্তির
স্পষ্ট উপন্যাস,
খুঁজি
যেন সকালের সূর্য থেকে সন্ধ্যার সূর্যের হবি
শুনি যেন
আমাদের কান্নার অতলজলে অমর ভৈরবী
প্রত্যহের
সচেষ্ট উৎসবে,
সহজ
অভ্যাস ফেলে সকালে সন্ধ্যায় বারো মাস
বছরে
বছরে পড়ে যাই জীবনের স্বাধীন বিন্যাস,
নিভৃত ছায়ার চৈত্রে শালবনে
তোমার বসন্ত গানে রক্তরাগে হৃদয়
স্পন্দনে
আমাদের দিনের পাপড়িতে, জীবনের ফুলে ফলে
ভ্রমরগুঞ্জনে নব পল্লবমর্মরে
গড়ে তুলি আজ কাল, মাসে মাস, শত বর্ষ পরে
আমাদের প্রতিদিন, কবি।
0 Comments