আমার কৈফিয়ৎ - কাজী নজরুল ইসলাম
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই, কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা পড়ে শ্বাস ফেলে।
বলে, ‘কেজো ক্রমে হ’চ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাঁশ ঠেলে।
পড়েনাক বই, বয়ে গেছে ওটা!’
কেহ বলে, ‘বউ-এ গিলিয়াছে গোটা।‘
কেহ বলে, ‘মাটি হল হয়ে মোটা জেলে বসে শুধু তাস খেলে।‘
কেহ বলে, ‘তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যাস জেলে।‘
গুরু কন ‘তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা।‘
প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা।
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি---‘
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা কন আড়ি চাচা,
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা।
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লা’রা কন হাত নেড়ে,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম---কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও !
‘আম পারা’-পড়া হামবড়া মোরা এখনও বেড়াই ভাত মেরে।’
হিন্দুরা ভাবে, ‘ফারসি শব্দে কবিতা লেখে ও পাত-নেড়ে।
আনকোরা যত ননভোয়োলেন্ট নন্-কো-র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োলেন্সের ভায়োলিন’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি।
‘এটা অহিংস,’ বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চরকার গান কেন গাবে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কনফুসি।
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি’।।
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী।
‘বিলেত ফেরনি? “প্রবাসী-বন্ধু” কন, ‘এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি’!-–
যুগের না হই, হুজুগের কবি
বটি তো রে দাদা, আমি মনে ভাবি আর কষে কষি হৃদ-পেশী,
দু-কানে চশমা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হতেছে নিদ্ বেশী!
কী যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু, আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হল না তো ভাই, তাই লিখি করে ঘাড় নীচু।
বন্ধু! তোমরা দিলে নাক দাম
রাজ-সরকার রেখেছেন নাম!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য বলে অ-মূল্যে নেন। আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?
বন্ধু! তুমি তো দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে
হাড় কালি হ’ল, শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দিরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তারে করিনু বিকল।
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না রবি-গান্ধিরে!
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে।
আমি বলি, ওরে কথা শোন্ খ্যাপা, দিব্যি আছিস্ খোশহালে
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হয়ে উঠেছিস্, এবার এ দাঁও ফস্কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়।
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।
বোঝেনাক যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুনে সবে ভাবে, ভাবনা কী? দিন যাবে এবে পান খেয়ে।
রবে নাক ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন,
বেলা বয়ে যায় খায়নিক বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান, তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন
কেন ওঠেনাক তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা তো জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস।
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস;
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারী সমাজ।
মার বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ।
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এই রক্ত লেখা,
বড়ো কথা বড়ো ভাব আসেনাক মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে।
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে!
প্রার্থনা করো---যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
0 Comments